শুক্রবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১:৫৬ অপরাহ্ন

সংবাদ শিরোনাম :
১৫ বছরে শতকোটি টাকা লুটেছে শমী সিন্ডিকেট

১৫ বছরে শতকোটি টাকা লুটেছে শমী সিন্ডিকেট

স্বদেশ ডেস্ক:

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে ইশতিয়াক মাহমুদ নামে এক আন্দোলনকারীকে হত্যাচেষ্টার ঘটনায় রাজধানীর উত্তরা পূর্ব থানায় দায়ের হওয়া মামলায় গত মঙ্গলবার রাতে গ্রেপ্তার হয়েছেন ই-ক্যাবের সাবেক সভাপতি ও অভিনেত্রী শমী কায়সার। গতকাল বুধবার তাকে তিন দিনের রিমান্ডে পেয়েছে পুলিশ। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তিনি ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের আমলে বিভিন্ন সেক্টরে দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার করে ঠিকাদারি কাজ বাগিয়ে নেওয়াসহ তদবির বাণিজ্যের বিষয়ে পুলিশের কাছে বিভিন্ন তথ্য দিয়েছেন।

আমাদের সময়ের অনুসন্ধানে জানা গেছে, ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) বিভিন্ন দপ্তরে শক্ত সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন শমী কায়সার ও তার ব্যবসায়িক পার্টনার আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা মৃণাল কান্তি রায়। ক্ষমতার অপব্যবহার করে তারা বিমানবন্দরের লাউঞ্জ ও দোকান বরাদ্দ, পণ্য সরবরাহ, বিনা টেন্ডারে ডিজিটাল ব্যানার ব্যবসা, ক্রেস্ট বাণিজ্যসহ বেবিচকের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে শমী কায়সারের প্রতিষ্ঠান ‘ধানসিঁড়ি কমিউনিকেশন’ ও মৃণালের ‘এক্সিকিউশন’ ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের নামে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। এসব বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তরসহ দুর্র্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) অভিযোগও জমা পড়েছে। হয়েছে একাধিক তদন্ত কমিটি। কিন্তু শমী-মৃণাল সিন্ডিকেটের ক্ষমতার দাপটে কোনো তদন্তই আলোর মুখ দেখেনি। সেসব অভিযোগের বিষয়ে বেবিচক ও বেসামরিক বিমান পরিবহন এবং পর্যটন মন্ত্রণালয় ফের তদন্তের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে।

গত ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর শমী-মৃণাল সিন্ডিকেটের সদস্যরা গা ঢাকা দিলেও সম্প্রতি তারা মাথা চাড়া দিয়ে ওঠার চেষ্টা চালাচ্ছেন। এর মধ্যেই শমী কায়সারের গ্রেপ্তারের খবরে অনেকটাই বেকায়দায় পড়েছেন সিন্ডিকেটের সদস্যরা। শমী কায়সারকে গ্রেপ্তারের পর তার দুর্নীতির দোসর মৃণাল কান্তিও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরদারির মধ্যে রয়েছে বলে জানা গেছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, শমী কায়সারের ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠান ‘ধানসিঁড়ি’ ও মৃণাল কান্তির ‘এক্সিকিউশন’-এর মাধ্যমে শাহজালাল বিমানবন্দরে গত ১৫ বছর প্রভাব খাটিয়ে কোটি কোটি টাকার কাজ বাগিয়েছেন তারা। এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে অনুসন্ধানের জন্য ২০২২ সালে বিমান মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয় দুদক। রহস্যজনক কারণে সেই তদন্ত বেশি দূর এগোয়নি। বহাল তবিয়তে কাজ করে গেছেন তারা। বরং বারবার তাদের ইজারা চুক্তি নবায়ন করে কোটি কোটি টাকা কামানোর সুযোগ করে দিয়েছেন বেবিচকেরই এক শীর্ষ কর্মকর্তা। ওই কর্মকর্তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সূত্রে প্রভাব খাটিয়ে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের প্রায় সব কাজই বাগিয়ে নিত শমীর প্রতিষ্ঠান। ২০২৩ সালের ১৫ অক্টোবর রাজধানীতে এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের দেশগুলোর অংশগ্রহণে ইকাও-এর ৫৮তম ডিজিসিএ সম্মেলন শুরু হয়। প্যান প্যাসিফিক হোটেল সোনারগাঁওয়ে এর উদ্বোধন করেন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলী। সম্মেলনে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ৩৬ দেশ ও ১১টি আন্তর্জাতিক সংগঠনের মহাপরিচালক ও চেয়ারম্যান এবং তাদের প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেন। এই অনুষ্ঠানের ইভেন ম্যানেজমেন্টের কাজ যৌথভাবে সম্পন্ন করে শমী ও মৃণালের প্রতিষ্ঠান। পুরো অনুষ্ঠানে দুই কোটি টাকা খরচ না হলেও তারা বিল তুলে নেন ১৫ কোটি টাকা।

জানা গেছে, শমী কায়সার ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) সভাপতি ছিলেন। ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর গত ১৪ আগস্ট শমীকে পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। আর মৃণাল কান্তি গত ৫ আগস্ট থেকে পলাতক রয়েছেন। আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে তাদের আশীর্বাদপুষ্টদেরই বিমানবন্দরের বিজ্ঞাপনের জন্য বিলবোর্ড, লাউঞ্জ ও ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের কাজ দেওয়া হতো। গত ১৫ বছর ধরে শাহজালাল বিমানবন্দরে ধানসিঁড়ি নামে দুই কোটি ৬২ লাখ ২ হাজার ৪৫৬ টাকা মূল্যের দুটি লাউঞ্জ নামমাত্র মূল্যে (৮৯ লাখ ১৫ হাজার ৬৬২ টাকা) ইজারা নিয়ে জবরদখল করে আছে শমী কায়সারের প্রতিষ্ঠান। এতে সরকার দেড় কোটি টাকার বেশি রাজস্ব বঞ্চিত হয়। আর ধানসিঁড়ি লাউঞ্জ শমী নিজে পরিচালনা না করে সিটি ব্যাংককে ভাড়া দিয়ে প্রতিমাসে হাতিয়ে নেন ২ কোটি টাকা। তাদের সিন্ডিকেট এতই শক্তিশালী যে, আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পরও তার ইজারা চুক্তি নবায়ন করা হয়।

মৃণাল কান্তি গত চার বছর ধরে শাহজালালে সব ধরনের ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের কাজ করতেন। করোনাকালে দূরত্ব বজায় রাখার জন্য শাহজালালে চৌকোনা ছক এঁকেই বাগিয়ে নেন দুই কোটি টাকা। সিভিল অ্যাভিয়েশনের বড় বড় অনুষ্ঠানে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের কাজ মৃণাল কান্তি ছাড়া কাউকে দেওয়া হতো না। কাজ বাগিয়ে নিতে বেবিচকের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের দামি দামি উপহার দিতেন তাদের সিন্ডিকেটের সদস্যরা।

দুদক কর্তৃক বিমান মন্ত্রণালয়ে পাঠানো এক চিঠিতে বলা হয়, করোনকালীন কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ইজারা মূল্য পরিশোধ না করায় তাদের ইজারা বাতিল করে উচ্ছেদ করা হয়। এখানে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম শমী কায়সারের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান ধানসিঁড়ি। শমী পরিচালিত ২৩৫২.৯১ বর্গফুট লাউঞ্জের (সিটি এমেক্স) ইজারা মূল্য কখনই পূর্ণাঙ্গভাবে দেওয়া হয়নি। ৮০ লাখ ১৭ হাজার ৪৫০ টাকা অনাদায়ী বকেয়া পরিশোধের জন্য প্রতিষ্ঠানটিকে চূড়ান্ত পত্র (সংযুক্তি) প্রদানপূর্বক সময় দেওয়া হলেও প্রতিষ্ঠানটি (ধানসিঁড়ি) বকেয়া পরিশোধ করেনি। বর্তমানে প্রায় ৮০ লাখ টাকা বকেয়া প্রদান না করে প্রতষ্ঠিানটি বহাল তবিয়তে তাদের ব্যবসা পরিচালনা করে যাচ্ছে। দুদকের কাছ থেকে এই চিঠি পাওয়ার পর বিমান মন্ত্রণালয় বেবিচককে তদন্ত করে ব্যবস্থা এবং প্রতিবেদন পাঠানোর নির্দেশ দেয়। কিন্তু অদ্যাবধি সেই প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়নি। উপরন্তু বারবার শমী কায়সারের ইজারা নবায়ন করা হয়েছে।

বেবিচক চেয়ারম্যানের বরাত দিয়ে বেবিচকের সহকারী পরিচালক (জনসংযোগ) মুহাম্মাদ কাউছার মাহমুদ আমাদের সময়কে বলেন, ইভেন্ট মেনেজমেন্টসহ বিভিন্ন ইজারার বিষয় দেখার জন্য আইন শাখাকে বলা হয়েছে। বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। শমীসহ যাদের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে, তদন্তে প্রমাণ পাওয়া গেলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877